এ বছর বই মেলায়
লেখক রাজীব জবরজং-এর একটি কবিতার
বই বেরিয়েছে। নাম 'রৌশনবানীতে দাঙ্গাঁ
চলতেছে'। ঘাসফুল প্রকাশনী
থেকে প্রকাশিত এই বইটি হাতে
পেতে যদিও কিছুটা সময়
লেগেছে তবু্ও উচ্ছ্বসিত হয়েছি নতুন বইয়ের ঘ্রাণে
। অনলাইনে বইটি অর্ডার করেছিলাম, কোনো কারনে বইটি
পৌঁছাতে স্বাভাবিকের চাইতে বেশি সময় লাগলো।
ব্যাক্তিগতভাবে লেখকের সাথে আমার আলাপ
আছে ,বলতে গেলে ভাই-বন্ধুসুলভ সম্পর্ক। লেখকের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা আলোকচিত্র,চিত্রনাট্য এবং চলচ্চিত্র নিয়ে।আমাদের
দেশে লেখালেখি করে পেট চালানো
মুশকিল ব্যাপার তাই বলতে গেলে
পেটের দায়ে তিনি সুদূর
অষ্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছেন।এটিই লেখকের প্রথম প্রকাশিত কোনো বই।
বইটি
হাতে পেয়ে পাতা উল্টে
আমার প্রথমেই মনে হয়েছে এটি
কোনো সাধারন ধাঁচের কবিতার বই না তাই
সময় নিয়ে বেশ কিছুটা
মনযোগ দিয়ে পড়বো বলে
কয়দিন মুরগির ডিমে তা দেয়ার
মতন করে বইটা বুকশেল্ফে
সাজিয়ে রেখেছিলাম।
এবার আসি বইটি পড়ে আমার কেমন লাগলো সে কথায়, নি:সঙ্গ এক সত্তার গভীর আত্ন চেতনায় ভারাক্রান্ত অবচেতন মনের নিদারুণ সব পংক্তিমালা যেন! কখনো কখনো মনে হয় প্রতিটি পাতায় নতুন নতুন কবিতা আবার কখনো মনে হয় পুরো বইটিই একটি দীর্ঘ কবিতা। আমি কবিতার সমালোচক নই, সে সাহসও আমার নেই তবে বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে আছে কবিতার প্রতি অগাধ ভালোবাসা আর ছন্দ জ্ঞান। ব্যাকরণ ও প্রকরণগত বিষয়গুলো বাদ দিলে নি:সন্দেহে পাঠক হিসেবে এই কবিতার বইটি আমাকে আপ্লুত করতে সক্ষম হয়েছে। কবিতার ভাষা যেন কবির নিজস্বতাকেই ফুটিয়ে তুলেছে।
বইটি পড়তে পড়তে কখনো কখনো মনে হয়েছে যাদু বাস্তবতার অলিতে গলিতে উদাস এক পরিভ্রমণ চলছে। পংক্তিতে পংক্তিতে প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে কবির মৃত্যু চেতনা।
যেমন,
"যদি
কাল খুব ভোর টুপ
করে ঝরে যাই জীবনের
ডগা ভেঙে!
আমাকে
কুড়িয়ে নেবার আগ পর্যন্ত কতখানি
ধুলো জমে যেতে পারে
এই ঝরে পড়া শরীরে
তার অনুমান কিন্তু আমি ঠিকই করতে
পারি।"
আবার
"ধরো
বৃষ্টিতে তুমি ঝরলা, অথচ
তোমারে কেউ নিল না!"
আবার
"মরতে
গিয়ে বারবার ঘুমিয়ে পড়েছি, অথচ ঘুমোতে গিয়ে
একবারও মরছি না।"
আবার আছে কল্পনার শত শত রং যেমন পরের লাইনেই
"ঘুম
আর মৃত্যুর মাঝের সাঁকোটার তলায় বয়ে যাওয়া
নদীটার
তালানিতে একবার ডুব মেরে জেনেছিলাম
কিছু রং করা মাছ।
আর জেনেছিলাম মাছেরা কাঁদলে নদীতে ঢেউ আসে।
মাছেরা
হাসলে পদ্ম ফোটে। আর
মাছেরা ঘুমোতে গেলে শাপলার শালুক
সিথানে বসে পবন মাঝির
গল্প শোনায়।"
রাজিব জবরজংয়ের কবিতায় মৃত্যু চেতনার পাশাপাশি কখনো কখনো স্থান পেয়েছে সময় চেতনাও। হাসপাতালের ব্যথা বেদনার শয্যায় শুয়ে শুয়ে কখনো সময়কেই বন্ধু করে নিয়েছেন। লিখেছেন, প্রিয় সময়, তোমার ঘুরতে থাকা খোঁপার কাঁটা দেখে আমার ভালো থাকা না থাকাও বলতে ইচ্ছে করছে না।"
ঘড়ির কাঁটাকে খোঁপার কাঁটার সাথে তুলনা করে কবি তাঁর উপমা ব্যবহারের দারুণ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে ভ্রমণ করে এসেছেন সেই জন্ম থেকে রূঢ় বাস্তবতার বর্তমান অবধি, জেনেছেন মানুষ নামের মানুষ আর নেই।
যেমন
"তোমরা
যখন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আটাশে সেপ্টেম্বর উনিশশো কত যেন!
তখন আমি মায়ের পেট
থেকে কাঁদতে কাঁদতে পৃথিবীতে এসে পড়েছি।
এসে
দেখি পৃথিবী নামে কোনো দেশ
নাই, আবার মানুষ নামেও
কোনো মানুষ নাই!"
"সময়
একটা গ্রামের নাম। এই গ্রামে
বহুকাল আগে কেউ একজন
সময়ের বাজার বসিয়ে
সময়
কেনা বেচা করত।"
"যতবার
নি:শ্বাস নেই ততবারই মরি,
মরা হাঁটলে আমি হাঁটি, মরা
কাঁদলে, কাঁদি।
আর
ঐ শালা দেয়াল ঘড়ি
ঘুরে ঘুরে বৃথা বৃত্ত
আঁকে।"
কখনো
কখনো তাঁর কবিতায় শৈশব,
কৈশোরের দুরন্তপনার স্মৃতি ঘুড়ি উড়েছে পত
পত করে। যা আমার
মতো ক্ষুদ্র পাঠককেও তুমুল নাড়া দিয়ে যায়।
"আমার
সবুজ ঘুড়ির লেজে চড়ে আমার
জগতের সকল প্রজাপতি উড়ে
গেল।"
যেমন
"একদিন
তোমাদের মেশিনগানের বুলেটে আমাকেও সেলাই করে দিয়ো আমার
বাংলাদেশের মানচিত্রে।"