ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনাসহ বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে টানা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এরই মধ্যে দেশটির সামরিক বাহিনীর একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা, পরমাণু বিজ্ঞানী ও ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনকেন্দ্রকে টার্গেট করা হয়েছে। এসব হামলার পাল্টা জবাব দিতে ছাড় দিচ্ছে না ইরানও। ফলস্বরূপ মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাবস্থার মতো উত্তেজনা বিরাজ করছে।
মঙ্গলবার ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কোরের (আইআরজিসি) খাতাম আল-আনিবিয়া শাখার প্রধান আলী সাদমানিকে হত্যা করার দাবি করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। আলী সাদমানিকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। পাঁচ দিনের মধ্যে এটি ইরানের দ্বিতীয় শীর্ষ সেনা কর্মকর্তার মৃত্যু।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ বলেছেন, ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানা হয়েছে এবং আরও ১০টি স্থাপনা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। এছাড়া ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা, জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার, গ্যাসক্ষেত্র, বিমানবন্দর, রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল এবং বিভিন্ন বেসরকারি স্থাপনাও হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
তিনি আরও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “আয়াতুল্লাহ খামেনিকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, কী পরিণতি হয়েছিল ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের।” এর মাধ্যমে তিনি খোলাখুলিভাবেই ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন।
এদিকে ইসরায়েলের আগ্রাসনের জবাবে দেশটির সামরিক ও গোয়েন্দা স্থাপনায় পাল্টা হামলা চালাচ্ছে ইরান। ইসরায়েলের হার্জলিয়া শহরের একটি স্পর্শকাতর স্থাপনায় আঘাত হানার দাবি করেছে তেহরান। একইসঙ্গে সামরিক গোয়েন্দা কেন্দ্র ও মোসাদের অপারেশনাল সদর দপ্তরেও হামলা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছে ইরান। ইসরায়েল এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি।
মঙ্গলবার দিনভর ইরানের রাজধানী তেহরান এবং ইস্পাহান, কাশান ও লোরেস্তানসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। সোমবার মধ্যরাতে তেহরানের পূর্বাঞ্চলে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটে, যার পর আকাশে ধোঁয়ার কুন্ডলী দেখা যায়। একই সময়ে নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনাতেও সক্রিয় হয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ২২৪ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া কাশান শহরে আরও তিনজন নিহত এবং চারজন আহত হয়েছেন। লোরেস্তান প্রদেশে নিহত হয়েছেন ২১ জন। তেহরানে রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম আইআরআইবির ভবনে হামলায় নিহত হন তিনজন কর্মী।
হতাহত পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সব চিকিৎসক ও নার্সদের ছুটি বাতিল করে দ্রুত হাসপাতালে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ইরানের স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী সায়েদ সাজ্জাদ রাজাভি।
টানা হামলার ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তেহরানবাসী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আহ্বানে অনেক বাসিন্দাই রাজধানী ছাড়তে শুরু করেছেন। একজন তেহরানবাসী বিবিসিকে বলেন, “শহরটা এখন ফাঁকা হয়ে গেছে। শুধু তারাই আছে যাদের যাওয়ার জায়গা নেই।”
ইরানের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ‘শত্রুপক্ষের’ অন্তত ২৮টি আকাশযান গুলি করে ধ্বংস করা হয়েছে, যার মধ্যে একটি গোয়েন্দা ড্রোনও রয়েছে।
ইরানও পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের তেলআবিব, জেরুজালেম এবং হার্জলিয়াসহ চারটি শহরে আঘাত হেনেছে। হার্জলিয়ার আটতলা একটি ভবন আংশিক ধসে পড়েছে এবং একটি বাসে আগুন ধরে যায়। ইসরায়েল জানিয়েছে, এসব হামলায় এ পর্যন্ত ২৪ জন নাগরিক নিহত হয়েছেন।
আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ইসরায়েলি নাগরিকদের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ চেয়ে ১৪ হাজার আবেদন জমা পড়েছে। এসব হামলায় দেশটির জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার, বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এ সংঘাত আরও দীর্ঘমেয়াদি ও বিধ্বংসী রূপ নিতে পারে। এটি শুধু ইরান-ইসরায়েল সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে অস্থির করে তুলবে।